আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ হলো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার। এর ফলে এমন অনেক রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলোর কারণে একসময় মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতো। এখন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে মানুষ কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে, দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াতে পারছে। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিকের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
অ্যান্টিবায়োটিক হলো এমন একটি উপাদান, যা ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি করে অন্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস অথবা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা যা সংগঠিত হয়, যখন কতিপয় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে অভিযোজিত হয়ে যায় বলে, নিজেদের স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে তাদের রোগ সেরে যেত, এখন আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না, বরং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং এসব রোগাক্রান্ত মানুষ বা পশু অন্য কারো উপস্থিতিতে হাঁচি-কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয় এবং তারাও একই রকম দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়।
ধরুন, আপনার গলা ব্যথা? কাহিনী হয়তো আর কিছুই না, কিছু ব্যাক্টেরিয়া আপনার টনসিল আক্রমণ করেছে। আপনি ডাক্তার দেখালেন। তিনি হয়তো আপনাকে ৫-৭দিন খাওয়ার জন্য একটি অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করলেন। অ্যান্টিবায়োটিক ৩দিন খেয়েই দেখলেন, বাহ! ব্যথা তো পুরো ভ্যানিশ। মনে মনে খুশি হলেন। সাত দিনের ডোজ তিন দিনেই বন্ধ করে দিয়ে ভাবলেন, বাঁচলাম! ৭দিন আর খাওয়া লাগলো না।
আপনার ৩ দিনের ডোজে হয়তো কিছু ব্যাক্টেরিয়া মারা গেল, কিন্ত কিছু ব্যাক্টেরিয়া আবার অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে রইল। বেঁচে থাকা ব্যাক্টেরিয়া গুলো তখন গোল-টেবিল বৈঠকে বসে যায় আর ভাবতে থাকে, ‘এর উপায় কি?’ নিজেদের মত করে তারা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের গুনাগুণ বিশ্লেষণ করতে থাকে এবং এক সময় কোন না কোন দুর্বলতা খুঁজে পায়। বংশ বিস্তারের সময় সে অনুযায়ি নিজেদের মধ্যে মিউটেশন করে এবং আরও শক্তিশালি রূপে আবির্ভূত হয়। পরবর্তীতে ওই শক্তিশালি ব্যাক্টেরিয়া যখন আপনাকে আবার আক্রমণ করে তখন আপনি পুরো অসহায়। সামান্য ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে জ্বর/শরীর ব্যথায় আপনি শয্যাশায়ী। আগের অ্যান্টিবায়োটিক তখন আর আপনার কোন কাজে আসেনা। আপনাকে নিতে হয় পরবর্তী জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক। আর এভাবে দেখা যায়, ফার্স্ট জেনারেশন, সেকেণ্ড জেনারেশন, অনেক সময় থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকও আমাদের ইনফেকশন কমাতে পারে না। আর এজন্য দায়ী একমাত্র আমারাই।
ভাবলেন ৭ দিনের জায়গায় ৩দিন খেয়েই যদি ভাল হয়ে যাই, সমস্যা কি? খরচ তো বাঁচল। কিন্তু ফার্স্ট জেনারেশনের তুলনায় থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি। ফার্স্ট জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিকের অসম্পূর্ণ ডোজ খেয়ে আপনি যে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া গ্রুপ তৈরি করলেন, সেটা ধ্বংস করতে পরবর্তিতে আপনাকে যে ৫/৬গুন বেশি দামের থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকের শরণাপন্ন হতে হবে না, তা কে জানে।
হয়তো একটা সময় আসবে যখন, আর কোন জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকই আর কাজ করবেনা। ফলে সামান্য অসুখেও হয়তো ভুগতে হবে অনেক বেশি বা শেষ হয়ে যেতে হবে তিলে তিলে।
তাহলে আমাদের করনীয় কি?
– মনের মাধুরি মিশিয়ে ফার্মেসি থেকে নিজের ইচ্ছামত যে সে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাওয়া চলবেনা। দেহের প্রতিটা সিস্টেমেরই অ্যান্টিবায়োটিক আলাদা, সেটা ডাক্তারই একমাত্র বুঝতে পারেন, আপনি ডাক্তার নয় এমন ব্যক্তির পরামর্শ অনুযায়ী এক সিস্টেমের ঔষধ অন্য সিস্টেমের জন্য খেলে দিন শেষে বিপদে পড়বেন আপনিই।
– একজন ডাক্তার যতদিন খেতে বলবেন ঠিক ততদিন খাবেন। ৫দিন বললে ৫দিন, ৭দিন বললে ৭দিন।
– প্রেসক্রিপশনে লেখা নিয়ম অনুযায়ি ঔষুধ খেতে হবে। দিনে তিনবেলা হলে তিনবেলা কিংবা চারবেলা হলে চারবেলা।
– সামান্য ভাইরাল জ্বরে নিজে মাতবরি করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবেনা। কারন ভাইরাল ফিভারে অ্যান্টিবায়োটিকের কোন রোল নেই। এইজন্যই কথায় বলে, ‘ভাইরাল ফিভার? নো প্রবলেম, ওষুধ খেলে ৩দিন, না খেলে এক সপ্তাহ’।
– যথাযথ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসির ‘দোকানদার কাম ডাক্তার(!)’ এর পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।আপনার আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবকেও এ সম্পর্কে সতর্ক করুণ।
– আপনি আপনার আশপাশের মানুষজনকে বিশেষত পরিবারের মানুষজনকে সতর্ক না করলে একটা সময় আপনি ভুলভাল অ্যান্টিবায়োটিক না খেলেও আপনার নিজের বিপদ হতে পারে। কারন ভুল অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার কারনে বা লো ডোজ খাওয়ার কারনে আপনার আশপাশের লোকজনের শরীরে যে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে সেগুলো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে আপনার দেহেও চলে আসতে পারে, তখন তাদের মতো আপনারও একই পরিণতি হবে।
তাই চলুন, সময় থাকতে নিজে সচেতন হই আর অন্যকেও সচেতন করি।
ধন্যবাদ